১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে বিজয়ের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর জাতির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের শাসন ভার গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী তিন বছর উক্ত পদে তিনি আসীন থাকেন। এরপর ১৯৭৫ সালে ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরিচালিত নয় মাস ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞ’ কে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধ্বংসযজ্ঞ উল্লেখ করে ৩০ লাখ মানুষ নিহত ও দুই লাখ নারীর ধর্ষণ হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনগনের উচ্চ আশা আকাংখা বঙ্গবন্ধু সরকারের জন্য পূরণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়তে থাকে। জাতীয় রক্ষীবাহিনী একটি নিয়মিত আধা সামরিক বাহিনী যা নব প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের ১৯৭২ সালে রক্ষীবাহিনী আইন ১৯৭২ দ্বারা গঠিত হয়। শুরুতেই মুজিব বাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে এই বাহিনীর পত্তন করা হয়। ঢাকার শেরে বাংলা নগরে এই বাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। ক্যাপ্টেন এ, এন, এম নূরুজ্জামানকে রক্ষী বাহিনীর প্রধান করা হয় এবং বিদ্রোহ দমন এবং আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য গঠিত হয়। এটি ছিল একটি বিতর্কিত আধা সামরিক বাহিনী যা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অনুগত ছিল। এটি বেসামরিক জনগনের কাছ থেকে অস্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য গঠিত হলেও অনেকের মতে এটি প্রকৃত পক্ষে মুজিবের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া থেকে রক্ষা করতে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে। এর কর্মীদের বিরুদ্ধে জনসাধারণ ও আওয়ামী লীগ বিরোধীদেরকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। সামরিক শক্তির প্রভাবের কারনে পাকিস্তান আমলে বাজেটের বেশীর ভাগই সামরিক খাতে ব্যয় হত। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সে বরাদ্দ কমতে থাকে এবং ১৯৭৫-১৯৭৬ সালের বাজেটে মুজিব সরকার রক্ষী বাহিনী সৃষ্টির জন্য প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ করে সেনাবাহিনীর বরাদ্দ ১৩% নামিয়ে আনে। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। স¦াধীনতা পরবর্তী সামরিক বাহিনীর বাজেটে হ্রাস ও দুর্দশার জন্য রক্ষীবাহিনীকে দায়ী করা হলেও তা ছিল ভিত্তিহীন, কেননা ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে রক্ষীবাহিনীর জন্য বাজেট ছিল মাত্র নয় কোটি টাকা এবং পরবর্তীতে ১২২ কোটিতে পৌঁছায়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী অনেক সেনা তাদের আশানুরুপ পদোন্নতি পাননি বলে ও দাবী রয়েছে। এসকল কারণে সেনাবাহিনীর মধ্যে তৈরী হওয়া ঘনীভূত অসন্তোষ বিদ্যমান ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সশস্ত্র বাহিনীর জওয়ান দের সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার তার মধ্যে পাকিস্তান প্রত্যাগত জওয়ানদের সংখ্যা ২৪ হাজার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ান ও নতুন করে রিক্রুটদের মিলিয়ে মোট ছিল ২৭ হাজার। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের সংখ্যা ছিল ১১শত এবং রক্ষী বাহিনীতে সংখ্যা ছিল ২০,০০০ বিশ হাজার। স্বাধীনতার পর দেশের আইন শৃংখলার কিছু অবনতি ঘটে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে অস্ত্র উদ্ধার করতে পুলিশ ব্যর্থ হয়। সুতরাং অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব সেনা বাহিনীকে দেওয়া হত। রক্ষী বাহিনী সম্বন্ধে কিছু মহল বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অনেকে মনে করেন রক্ষী বাহিনী সেনা বাহিনীর বিকল্প হিসেবে গঠিত হয়। এবং একারনে অনেকটা সেনাবাহিনীর ভিতরেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। ঐ সময় রক্ষী বাহিনীকে কার্যকর করার জন্য পার্লমেন্টে আইন পাস হয় যাতে রক্ষী বাহিনীকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয় এ ব্যাপারে অনেক অপপ্রচার করা হয় এবং সামরিক বাহিনীতে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসাররা এক কথায় ভারত বিরোধী এবং রক্ষণশীল মুসলীম বিশে^র প্রতি অনুরক ছিল যার ফলে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মনে প্রাণে বিশ^াস ও গ্রহণ করেনি। মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কৃতিত্ব স্বরুপ দুই বছরের সিনিয়রিটি গ্রহণ করে ফলে প্রত্যাগত অফিসার গণ এতে ক্ষুদ্ধ হয়। পাকিস্তান শাসন আমলে বাজেটের সিংহভাগ সামরিক খাতে ব্যয় হলে ও সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ সংকটকালীন অবস্থায় বাজেটের ১৩% এর বেশী সামরিক খাতে ব্যয় করা জাতীয় নীতির সহায়ক নয় বলে প্রতীয়মান হয়েছিল। তাই তো সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু এসব কারনে অফিসারদের প্রতি কিছু টা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, আর্মি অফিসাররা আমার কাছে এসে একে অপরের বিরুদ্ধে বলে, অমুক এই করেছে, সে এই করেছে, অমুক এই বলেছে, আমার পোস্টিং, আমার প্রমোশন —– ইত্যাদি। সেনাবাহিনীর অফিসাররা এভাবে কামড়া কামড়ি করলে বা ডিসিপ্লিন না রাখলে এই সেনাবাহিনী দিয়ে আমার কি হবে? আমি কি করবো? আমি এদের ঠেলা ঠেলি সামলাবো, না দেশ চালাবো? আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে। সবাই খাই খাই শুরু করেছে। কোথা থেকে আমি দেব, তা কেউ ভাবতে চায় না। সবাই কে দেশ গড়ার কাজে সাহায্য করা উচিত। কিন্তু তা না করে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেনাবাহিনীর ভিতরে এক শ্রেণির কর্মকর্তারা এবং বিভন্ন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও সরকার বিরোধী মনোভাব পোষন করতে লাগল এবং বেভিন্ন ক্ষেত্রে দ্ব›দ্ব ও সংঘাত তৈরি করার ক্ষেত্রে ব্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল। যাহা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ উন্নতির পরিবর্তে অন্তরায় হয়ে দাড়ালো। সুতরাং এ থেকে দেখা যায় অফিসারদের অতি উচ্চ আকাংখা মুজিব সরকারের জন্য অত্যন্ত অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছায়। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র দশ হাজার সেনা সদস্যের আবাসিক বাসস্থানের সুযোগ ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়ে সেনা বাহিনীর সংখ্যায় ছিল মাত্র ২০ হাজার। তার উপর পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক বাহিনীর আরো প্রায় পঁচিশ হাজার সদস্য সেনা বাহিনীতে যোগ দান করেন। এরুপ অবস্থায় প্রায় ৪০/৪৫ হাজার সৈন্যের রাতারাতি আবাসিক সুবিধা প্রদান শুধুমাত্র কথার কথা ছিল না। ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, সৈয়দপুর, রংপুর এবং কুমিল্লায় সেনানিবাস গুলোতে তাদের সাময়িক আবাসিক সুবিধার জন্য ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয় মুজিব সরকার। সেনা বাহিনীতে সীমাহীন অপপ্রচার এবং ভুল বোঝাবুঝির ফলে শৃংখলা বিনষ্ট হয়। এমতাবস্থায় গ্রæপিং দলাদলি প্রভৃতি কারণে সেনা বাহিনীতে ষড়যন্ত্রকারীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অপর দিকে রক্ষী বাহিনীর সদস্যরা খাকি বর্ণের পোষাক পরিধান করতে রাজি ছিলেন না। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পোষাক খাকি বর্ণের হওয়ায় তারা তা অপছন্দ করতেন। ফলে মুজিব সরকার রক্ষী বাহিনীর জন্য জলপাই সবুজ পোষাক বরাদ্দ করে যা ছিল ভারতীয় সেনা বাহিনীর অনুরুপ। আবার রক্ষী বাহিনীর সদস্য গণ সুশৃঙ্খলিত ভাবে ডিউটিতে নিয়োজিত থাকতো এবং নীরবতা পালন করতো। এসব সুযোগ রটিয়ে দেওয়া হয় যে রক্ষী বাহিনীর সদস্যগণ ভারতীয়। আসলে এর কোন ভিত্তি ছিল না, সবই বানানো ও মিথ্যাচার। কিন্তু মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ রটনা কারীরা এর পূর্ণ সুযোগ নেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সেনা বাহিনীতে নানা কারণে বিভেদ বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা অফিসারদের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেনা প্রধান নিযুক্ত করণ নিয়ে ও সমস্যা দেখা দেয়। সিনিয়র অফিসার হওয়া সত্তে¡ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জিয়ার পরিবর্তে কে, এম শফিউল্লাহ কে সেনা প্রধান নিযুক্ত করেন। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল কে, এম শফিউল্লাহ কে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হলে শফিউল্লাহ এই নিয়োগের প্রতিবাদ করেন কারণ তিনি বলেন জিয়াউর রহমান ও আমার একই রকম যোগ্যতা থাকা সত্তে¡ ও তিনি ব্যাচ নাম্বারে আমার আগে ছিলেন অর্থাৎ আমার ১ নম্বর সিনিয়র ছিলেন। আমি মেজর রবকে সংগে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে এই প্রতিবাদ জানাই। বঙ্গবন্ধু শফিউল্লাহর সব কথা মনোযোগ সহকারে শোনেন। প্রায় দুই ঘন্টা যাবত তাদের ভেতর আলোচনা হয়। কিছু রাজনৈতিক বিষয় এর ভেতরে আছে বলে বঙ্গবন্ধু জনাব শফিউল্লাহ কে জানান, উক্ত নিয়োগটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে যখন জিয়াউর রহমান জানতে পারলেন তখন তিনি ব্যক্তিগত ভাবে মুজিব সরকারের প্রতি ক্ষুদ্ধ হন। ফলে জিয়াউর রহমান ও কে, এম শফিউল্লাহর মধ্যে সম্পর্কের অবণতি ঘটে। পরবর্তীতে অনেক অফিসার জেনারেল জিয়ার নিকট শেল্টার নিয়েছে। অনেকের মতে, বিশেষ করে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ (সাবেক তথ্যমন্ত্রী) এর মতে সব সময় সেনা বাহিনীতে প্রচার চলত যে, সকল গুণ ও মেধার আকর জিয়াউর রহমান। এ সকল বিষয়ের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ও বিভেদ ছিল চরম পর্যায়ে। জিয়াউর রহমানের জেড ফোর্স এবং খালেদ মোশাররফের ও শফিউল্লাহর কে ও এম ফোর্সের সদস্যদের মধ্যে বনিবনা ছিল না। জিয়া, খালেদ ও শফিউল্লাহর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই দ্বন্ধের সুত্রপাত ঘটে। যদিও ‘কে ও এম’ ফোর্সের সদস্যদের সেনা বাহিনীতে আধিপত্য বেশী হওয়ার কারণে জিয়ার সংগে খালেদ ও শফিউল্লাহর মধ্যে সু-সম্পর্ক ছিল না। কিছু কিছু সময় মুজিব সরকার বিরোধীরা স্বজন প্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। বিশেষ করে ১৯৬২ সালে সংঘটিত শিক্ষা আন্দোলনে শেখ ফজলুল হক মনি অত্যন্ত প্রভাব শালী যুব নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৭১ সালে তিনি মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ও তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন হলে তিনি এর অন্যতম সম্পাদক নিযুক্ত হন। মুজিব বিরোধীগন একে সুবিধা বাদী পদ মর্যাদা অ্যাখ্যা দেন। তার বিরুদ্ধে ভারতের সংগে বেসরকারী বানিজ্যে শেখ মুজিবের পৃষ্ঠপোষকতায় জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়। অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও সমালোচক তাকে শেখ মুজিবের বংশতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার একটি অংশ বলে অভিযোগ করেন। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ অনেক বিশ্লেষক নাকচ করে দেন। অনেক সময় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মীরাও দুর্নীতিতে বা স্বজনপ্রীতিতে জড়িয়ে পড়েন এমন সংবাদ ও শোনা যায়। তারা একে বারে ধোয়া তুলসী পাতা নন, যেখানে বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন কর্মকান্ডে সাহায্যে করবেন, তা না করে মুজিব সরকার কে এবং বঙ্গবন্ধু কে অনেক সমালোচিত করেছেন। এমন ঘটনা ও ঘটেছে, ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশী সুরক্ষা বাহিনী গোপনে সংবাদ পেয়েছিল যে, বামপন্থী বিপ্লবী কর্মী সিরাজ শিকদার এবং তার বিদ্রোহীরা ঢাকার আশেপাশে সমন্বিত হামলা চালাচ্ছে। পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা গণ পূর্ণ সর্তক ছিলেন এবং ঢাকার রাস্তায় সাধারণ পোষাকে টহল দিচ্ছিলেন, ১৯৭২-১৯৭৫ সালের মধ্যে উদীয়মান বামপন্থী শক্তি মুজিব হত্যা কান্ডের পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বহুল অংশে দায়ী ছিল বলে মনে করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং নব্য স্বাধীন দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়ে একটি মতাদর্শগত দ্বন্দের সূত্রপাত হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ গণতন্ত্রকে প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচনা করলেও আ, স, ম আঃ রব এবং শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বধীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তার বিরোধীতা করেন। ছাত্রলীগের এই অংশটি মূলত সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম খানের অনুসারী ছিল। তারা পরবর্তীতে ছাত্রলীগ থেকে বিভক্ত হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ নামক আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে, যার লক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, যেটিকে তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করতেন। মুজিবের নেতৃত্বে প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানে অবাধ গণতান্ত্রিক অধিকার সন্নিবেশিত হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলো অবাধ রাজনীতি করার অধিকার লাভ করে। কিন্তু অবাধ গণতন্ত্রের সুযোগ গ্রহণ করে অতি উগ্র বামপন্থী দল গুলো গোপনে সশস্ত্র দল স্কোয়াড গঠন করতে থাকে। থানা, ব্যাংক লুট করা হয়, খুন হত্যা রাহাজানি, ডাকাতি জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। জাসদে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সহ সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দীন এক সম্মেলনে ৪৭ টি থানা লুটের ঘটনা ও মুজিব হত্যায় নিজেদের দায় স্বীকার করেন। সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি বাংলাদেশকে ভারতের তাবেদার রাষ্ট্র আখ্যায়িত করে জনগনের গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আহবান জানায়। জাসদের উদ্দোগে প্রতিটি সেনা নিবাসে অত্যন্ত গোপনে গঠিত হয় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। এর ফলে সেনা বাহিনীর শৃংখলা বিনষ্ট হয়। কর্ণেল আবু তাহের এবং অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বে জাসদের সশস্ত্র শাখা গণ বাহিনী সরকারের সমর্থক, আওয়ামী লীগের সদস্য ও পুলিশদের হত্যার মাধ্যমে অভ্যুথানে লিপ্ত হয়। এর ফলে দেশে সর্বস্তরে আইন শৃংখলা ভাঙন ধরে এবং মুজিব হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার পথ প্রশস্ত করে দেয়। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান পন্থী হিসেবে, চীনা পন্থী গণ ভারত বিরোধী হিসেবে, জামায়াতে ইসলামীর স্বাধীনতা বিরোধী অনেক নেতা কর্মী মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে তারা সবাই কোন রাজনৈতিক দলের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে চেয়ে ছিলেন। এ অবস্থায় সিরাজুল আলম খান, আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ এর নেতৃত্বে জাসদ গঠিত হলে উপরিউক্ত রাজনৈতিক দলে অনেকে আশ্রয় গ্রহণ করেন। প্রধানত মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর যুবকদের একটি বিরাট অংশকে নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জাসদ হয়ে দাঁড়ায় শেখ মুজিবের সরকার বিরোধী যে কোন ধরন ও চরিত্রের লোকের আশ্রয়স্থল, ফলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করার জন্য যে জাসদের জন্ম তা পরিশেষে হয়ে দাঁড়ায় এক বহু শ্রেণী ভিত্তিক সংগঠন। পরবর্তীতে দলে কোনঠাসা, দল থেকে বহিস্কৃত এবং দুর্নীতিবাজ অনেক সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরা জাসদে যোগ দেন। চীনা পন্থী দল গুলো বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের পরপরই জাসদ নেতা কর্মীরা শেখ মুজিবুর রহমানের জাতীয় রক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে এবং রক্ষী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনীতি বিদদের বাড়িতে হামলা লুন্ঠন, নির্যাতন, হত্যা বিরোধী মতাদর্শের গুম করা সহ বেআইনী কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়। এরূপ জাসদের আন্দোলনকারী কর্মীরা ঢাকার রমনা এলাকায় অবস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোঃ মুনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করলে জাতীয় রক্ষী বাহিনীর সদস্যরা তাদের ওপরে গুলিবর্ষণ করে, যার ফলে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। সমস্ত দল অনেকটা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় এবং অনেক সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ইসলাম পন্থী দল গুলো আরো উগ্রভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে চেষ্টা করে মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ১৯৭৫ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু চলমান বহু দলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতি ব্যবস্থায় সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে রাষ্ট্রপতি শাসিত একদলীয় জাতীয় ঐক্যের সরকার, জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত দল ঘোষনার পর সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবি ও রাজনৈতিক দলের একাংশ তার বিরোধীতা করে। ফলে আমলাতন্ত্র, সেনা বাহিনী আর প্রশাসনের লোকজনের মধ্যে আবার নতুন করে দ্ব›দ্ব, সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি চুড়ান্ত অসন্তোষের পিছনে একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে প্রভাবক হিসেবে উল্লেখ করেন যে, ঘটনাটি কর্ণেল ফারুক রহমান কর্ত্তৃক বর্ণিত তাহল, টঙ্গীর মোজাম্মেল নামক এক সমসাময়িক আওয়ামী লীগ তরুণ নেতা যে এক নববধূ কে গাড়ী থেকে তুলে নিয়ে তার ড্রাইভার ও স্বামীকে হত্যা করার পর তাকে অপহরণ মূলক গণধর্ষন করে তিনদিন পর তার রক্তাক্ত লাশ রাস্তায় ফেলে যায়। এতে মেজর নাসের নামের বেঙ্গল ল্যান্সারের একটি কোম্পানীর অধিনায়ক মোজাম্মেল কে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। আবার পরপরই সে ছাড়া পেয়ে যায়। শেখ মুজিবের হস্তক্ষেপেই সে ছাড়া পায় এমনটি অনেকেই মনে করেন। এ ঘটনা সেনা বাহিনীতে, বিশেষ করে কর্ণেল ফারুকের ভেতরে শেখ মুজিব কে অভ্যুথানের মাধ্যমে উচ্ছেদ করার পরিকল্পার পেছনে অন্তিম মুহুর্তের চূড়ান্ত প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এভাবে আস্তে আস্তে করে দেশ প্রেমহীন, দেশ বিরোধী, মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী এবং বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু বিরোধী সেনাকর্মকর্তারা, প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এবং কিছু কিছু শ্রমিক নেতৃত্ব আওয়ামীলীগ থেকে দলছুট, স্বাধীনতা বিরোধী চক্র এবং সমাজতন্ত্রী পন্থী কিছু রাজনৈতিক সংগঠন সবাই একত্রে মিলে বঙ্গবন্ধু হত্যার ছক আটেন। এবং জাতির প্রতিষ্ঠাতা, জাতির বিবেক, জাতির অহংকার বঙ্গবন্ধু, তার স্ত্রী, সন্তান, ভাইসহ অনেক আত্মীয় স্বজনকে অত্যান্ত নিষ্ঠুর, নির্মম দয়ামায়াহীন নির্যাতনের মাধ্যমে ১৯৭৫ এর ১৫ ই আগস্ট মধ্যরাতের পর হত্যা করা হয়। যা জাতির ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। এমন হত্যাকান্ড যেন আর কখনও না ঘটে এবং আমাদের ইতিহাস আর যেন কখনও কলঙ্কিত না হয় এ ব্যাপারে আমাদের সকলকে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। আজকের এই শোকের মাসে মুজিব পরিবারের যারা বেঁচে আছেন তাঁরা যেন সবাই কষ্ট ও আঘাত ভুলে যেয়ে সফলভাবে, সুন্দর ভাবে, নিঃস্বার্থভাবে, দ্যর্থহীন ভাবে দেশ ও দশের জন্য কাজ করে যেতে পারে সেই প্রার্থনা আমরা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে আজ করি।
লেখকঃ জহিরুল ইসলাম শাহীন
সহঃ অধ্যাপক
বঙ্গবন্ধু মহিলা কলেজ
কলারোয়া, সাতক্ষীরা।