HEADLINE
সাতক্ষীরার পর এবার মাগুরার সিভিল সার্জনের বিরুদ্ধে জনবল নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ! কলারোয়ায় এক কৃষকের ঝু’ল’ন্ত লা’শ উ’দ্ধা’র কলারোয়ায় স্বামীর পুরুষা’ঙ্গ কে’টে দ্বিতীয় স্ত্রী’র আ’ত্ম’হ’ত্যা কলারোয়ায় স্বামীর পুরুষা’ঙ্গ কে’টে দ্বিতীয় স্ত্রী’র আ’ত্ম’হ’ত্যা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন : বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ ৫ দিন পর ভোমরায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম শুরু দেবহাটায় পাল্টাপাল্টি মারপিটে ইউপি চেয়ারম্যান ও আ’লীগ সভাপতি সহ আহত ৫ সাতক্ষীরা সীমান্তে নয়টি স্বর্ণের বার’সহ চোরাকারবারি আটক সাতক্ষীরায় চেতনানাশক স্প্রে করে দুই পরিবারের নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট আশাশুনির কোপাত বাহিনীর প্রধান কারাগারে
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:০০ অপরাহ্ন

আশাশুনি বাসীর দুর্দশা দেখার কেউ নেই

অজয় কান্তি মন্ডল / ৩৭৭
প্রকাশের সময় : বুধবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২১

বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলা হতে ২৭ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত ১১ টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত সম্ভবনাময় একটি উপজেলা ‘আশাশুনি’। প্রায় ৪০২ বর্গ কি. মি. আয়তনের এই উপজেলায় ২০০১ সালের আদমশুমারির প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রায় ২,৯২,২৯২ জন জনসংখ্যার বসবাস। আশা-শুনি নাম হতেই বোঝা যায় উপজেলাটির নামকরনের পিছনে কিছু একটা গল্প লুকিয়ে আছে। লোকমুখে শোনা যায়, বৃটিশ শাসন আমলে চব্বিশ পরগনা জেলার ভালুকা পরগনাভূক্ত  আশাশুনি উপজেলাটি ছিল বন্যভূমি। সমগ্র এলাকাকাটি  সুন্দরবনের অন্তর্ভূক্ত ছিল। বন্য হিংস্র জন্তু ব্যতীত কোন জনমানবের বাস উক্ত এলাকায় ছিল না। সর্বপ্রথম আব্দুস সোবহান নামে একজন কামেল ফকির কয়েকজন শিষ্যসহ আশাশুনি মৌজার (তৎকালীন সুন্দরবন) ঠিক মধ্যবর্তী স্থানে জঙ্গলের মধ্যে দুটি বৃহৎ বৃক্ষ দেখতে পান। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বৃক্ষটির তলায় তিনি তাঁর ব্যবহৃত হাতের লাঠি (আশা) টি মাটিতে পুতে রাখেন (গাড়েন) এবং নিজের আস্থানা ঠিক করেন। তখনকার দিনে বহু কাঠুরিয়া, মৌয়ালী ও বাওয়ালীরা জঙ্গলে  আসত এবং বন্য হিংস্র জন্তুর হাত থেকে বাঁচার জন্য উক্ত ফকিরের নিকট দোয়া প্রার্থনা করত। জীবিকার তাগিদে সুন্দরবনে আসা এসব মানুষের ধারণা ছিল ‘আশাগাড়া’ ফকিরই দোয়ায় তারা নিশ্চিন্তে বনের কাঠ, গোলপাতা, মধু ইত্যাদি আহরণ করতে পারছে। পরবর্তীতে বনের শ্রমিকদের কথামত দূর দূরান্ত থেকে সবাই আশা এর কথা শুনত। আশা-শুনি এই থেকে উপজেলাটি ‘আশাশুনি’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

আশাশুনি উপজেলাটির নামের সাথে সেখানে বসবাসকৃত মানুষের বাস্তব জীবন যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রাচীনকালের নামের সাথে সেখানকার মানুষ বাস্তবে ও তেমন ঠিক আশা শুনতে শুনতে এখন বেশ হয়রানি হয়ে গেছে। একটু পরিস্কার করে বললে সকলের কাছে বিষয়গুলো সহজ হবে। প্রথমে আসি যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে। লজ্জার বিষয় হলেও অতি সত্য যে আজও পর্যন্ত আশাশুনি উপজেলা থেকে রাজধানী ঢাকার সাথে সরাসরি কোন বাস সার্ভিস নেই। ঢাকা না হয় বাদ দিলাম। বিভাগীয় শহর খুলনার সাথে সরাসরি চলাচল করে এমন কোন সার্ভিস আশাশুনি বাসী পায়না। যোগাযোগ ব্যবস্থা যেখানে এত অনুন্নত সেখানে খুলনা বা ঢাকাগামী কোন পরিবহণ সেখানে ঢুকবে না এটাই স্বাভাবিক।

আশাশুনির অন্তর্গত ঘোলা-ত্রিমোহনী থেকে সাতক্ষীরা সদরের সাথে যোগাযোগের ৪২ কি. মি. দীর্ঘ রাস্তাটির বেহাল দশা মাঝেমধ্যে মানুষকে দ্বিধা দ্বন্দে ফেলে দেয় যে, এটি রাস্তা নাকি চাষ করা ফসলি জমি। সাতক্ষীরার সাথে সংক্ষিপ্ত দূরত্ব হওয়ায় আশাশুনির মানুষ ব্যতীত পার্শ্ববর্তী উপজেলা যেমন, শ্যামনগর, কালীগঞ্জ, তালা, পাইকগাছার অধিকাংশ লোকজন এই সড়ককে বেছে নেয়। কিন্তু রাস্তাটির বেহাল দশা নিয়ে সড়কে চলাচলকারী সকলের মনে বেশ ক্ষোভের সঞ্চার হয়। উক্ত সড়কের মধ্যে আশাশুনি থেকে ঘোলা-ত্রিমোহনী সড়কের অবস্থা ও খুবই নাজুক। বৃষ্টির মধ্যে উক্ত রাস্তার কিছু এলাকা দীর্ঘদিন ধরে পানির নিচে থাকার ও রেকর্ড রয়েছে। জনগণের বহু প্রতিক্ষার পর কর্তৃপক্ষ সংস্কারের নামে মাঝেমধ্যে এই সড়কের উন্নয়নের কাজ শুরু করে। কিন্তু মাঝ পথে গিয়ে বছরের পর বছর অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব মানুষের ভোগান্তি আরও চরমে তুলে দেয়। জনগণের মুখ বুজে নীরবে সহ্য করা ব্যতীত তাদের এসব ভোগান্তি দেখা বা এগুলো নিয়ে মুখ খোলার মত কোন ব্যক্তি আজ পর্যন্ত কাউকে দেখা যায়নি। 

আশাশুনি উপজেলার গা ঘেঁষে অবস্থিত মরিচ্চাপ নদীর উপরে নির্মিত ঘোলা-ত্রিমোহনীর ও জেলা শহরের সাথে সরাসরি সংযোগ রক্ষাকারী একমাত্র সেতু। কিন্তু সেতুটির দশা এতটাই বেহাল যে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ বা সেতুটির উপর দিয়ে যাতায়াত ব্যতীত কেউ তার প্রকৃত চিত্র বুঝবে না। বহু দিন আগে থেকে জোড়া তালি দিয়ে চলতে থাকা সেতুটিতে প্রায়শই অসংখ্য পথচারী দুর্ঘটনার স্বীকার হয়। সেতু ভেঙে যানবাহন নদীতে পড়ার ও বেশ রেকর্ড আছে। এক লেনের এই সেতু দিয়ে একটি বাস যদি পার হয় তাহলে ভ্যান সহ অন্যান্য যানবাহনের আর চলাচল করার মত জায়গা থাকেনা। যাত্রীদের সবসময় আতঙ্ক সাথে নিয়েই সেতুটি পার হতে হয়। সেই সাথে মাঝ নদীতে ভেঙে পড়ার ভয় তো আছেই।

আশাশুনি উপজেলা চত্ত্বরের আশপাশের পরিবেশ দেখলেই সহজেই দেশের অন্যান্য উপজেলা থেকে ফারাকটা বোঝা যায়। উপজেলা সদরের রাস্তা-ঘাট, বাজারের দোকান-পাট, সকলের কাছে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরবে। দেশে এমন উপজেলা দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমার জানা নেই। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় দেশের বহু উপজেলায় আমার ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে তবে আশাশুনির মত উপজেলা আমার চোখে পড়েনি। অন্তত পক্ষে সাতক্ষীরার অন্যান্য সকল উপজেলার পরিবেশ আশাশুনির চেয়ে উত্তম।

ছোট্ট একটি উদাহরণ দিইঃ সুন্দরবনের একেবেরে গা ঘেঁষে অবস্থিত অহরহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে লন্ডভন্ড করে দেওয়া একটি উপজেলা ‘কয়রা’। আইলা, সিডর, নার্গিস, বুলবুল, আম্ফান থেকে শুরু করে এমন কোন বড় ধরনের দুর্যোগ নেই যেটা কয়রাতে আঘাত আনেনি। কিন্তু বাস্তব হলেও সত্য এই কয়রা উপজেলা বেশ আধুনিক। কয়রার উপজেলা চত্ত্বরের যে জমজমাট বাজার সেটা আশাশুনির মত পাঁচটি উপজেলা একসাথে করলেও তার সমতুল্য হবেনা। শুধু বাজার না, কয়রা উপজেলা থেকে ঢাকার সাথে বেশ কয়েকটি পরিবহণের সরাসরি বাস সার্ভিস চালু আছে। বিভাগীয় শহর খুলনার সাথে চালু আছে সর্বাধিক দ্রুত গতি সম্পন্ন একের অধিক গেটলক বাস সার্ভিস।

আশাশুনি উপজেলার অধিকাংশ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস লোনাপানির চিংড়ী বা অন্যান্য মাছ চাষ। দেশীয় খাদ্য চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি সরকারের রপ্তানি বাণিজ্যের বড় একটা অংশ আসে আশাশুনিতে উৎপাদিত চিংড়ী, কাঁকড়া, কুঁচিয়া থেকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার তেমন কোন ভালো ব্যবস্থা না থাকায় অধিকাংশ ঘের মালিক তাদের কাঙ্ক্ষিত মূল্য পায়না। অনেকটা নিরুপায় হয়ে তুলনামূলক কম দামেই ঘের মালিকেরা তাদের মাছ, কাঁকড়া ও চিংড়ী বাজারজাত করেন।

কেউ ঢাকা শহরে যেতে চাইলে আগের রাতে এসে সাতক্ষীরা শহরে থেকে পরদিন ভোরের গাড়ীতে ঢাকা রওনা দিলে হয়ত দিনের ভিতর ঢাকা পৌঁছানো যায়। না হলে আশাশুনি থেকে চালুকৃত লোকাল বাস সার্ভিসে রওনা দিয়ে সাতক্ষীরা পৌঁছে ঢাকার পরিবহণে উঠলে সেদিনের ভিতর রাজধানী পৌঁছানো অনেকটা অনিশ্চিত। দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন যেন আশাশুনি বাসীর কাছে বড্ড বেশি বেমানান। প্রায় ২০ বছর আগে থেকে স্বচক্ষে দেখতে থাকা যোগাযোগ ব্যবস্থার সহ আশাশুনির সার্বিক অবস্থার এই বেহাল দশার আদৌ কোন গুণগত পরিবর্তন হয়নি। অথচ আশাশুনি বাসী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আশার বাণী শুনে এসেছে।   

আশাশুনি, সাতক্ষীরা-৩ আসনের অন্তর্ভুক্ত একটি উপজেলা। বিগত দিনগুলোতে উক্ত আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মহোদয় মন্ত্রী সহ সরকারের বেশ বড় পদে অধিষ্ঠিত থাকার সত্ত্বেও আশাশুনি উপজেলার কোনরূপ পরিবর্তন হয়নি। জনগণ পাইনি কোন রকম সুবিধা। নির্বাচনী সময় এলে জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিলেও সেগুলো প্রতিশ্রুতিই থেকে যায়। যদিও এগুলো দেশের খুব কমন একটা চিত্র। কিন্তু আশাশুনি উপজেলা যেন সবার থেকে একটু ব্যতিক্রম। আজ পর্যন্ত কেউ আশাশুনির উন্নয়নকে নিয়ে ভাববার মত সময় পাইনি। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতর রেষারেষি, ক্ষমতাসীন দলের ভিতরে আন্তঃ কোন্দল বা বিভিন্ন গ্রুপিং আশাশুনি উপজেলার এই বেহাল দশার জন্য দ্বায়ী করা যেতে পারে। যেগুলো আশাশুনি বাসীকে তাদের নায্য প্রাপ্ত অধিকার থেকে দিনকে দিন অনেকটা পিছিয়ে দিচ্ছে। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সরকারের স্থানীয় প্রসাশনের প্রতি বিষয়গুলো নিয়ে একটু গুরুত্বের সাথে ভেবে আশাশুনি উপজেলার উন্নয়নে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ রইল।

অজয় কান্তি মন্ডল,

গবেষক,

ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি,

ফুজো, ফুজিয়ান, চীন।


এই শ্রেণীর আরো সংবাদ