সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সঃ) একথা শুধু আমরা নয় সারা পৃথিবীর মানুষের। সততার দিক দিয়ে বলি, আদর্শের দিক দিয়ে বলি, নীতি নৈতিকতার দিক দিয়ে বলি, চরিত্রের কথা বলি, জ্ঞানের কথা বলি- এক কথায় সর্ব দিক দিয়ে বলি, তিনিই সর্বকালের সেরা। সেই একমাত্র আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ, মহাপুরুষ হিসাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর সকল মানুষের সত্যের পথ প্রদর্শন করার জন্য। মরুভূমির দুলাল, আরবের শ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (সঃ) সর্বগুনে গুনান্বিত একজন শ্রেষ্ঠ মানব সন্তান। তিনি মানব জাতিকে সত্য পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য ইসলামের আদর্শ ও সত্য বানী প্রচারের জন্য সারা দুনিয়াতে চির স্মরনীয় হয়ে আছেন। তিনি আল্লাহর দোস্ত, সর্বশেষ্ঠ রাসূল ও নবী। তিনি ধর্মবীর, কর্মবীর, তিনি প্রগতিশীল, তিনি সংস্কারক এবং একজন মহান সংগঠক এবং সমাজ পরিবর্তনের মহান অস্ত্র। তিনি শুধু সত্য ¯্রষ্টা মহা মানবই নন, পৃথিবীর ইতিহাসে তিনি অতুলনীয় এবং অপ্রতিদ্বন্দী। তিনি যখন পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করেন, তখন আরবের সর্বত্রই অরাজকতা, অশান্তি, বিশৃংখলা, অন্ধকার, অজ্ঞতার ছায়া বিরাজমান ছিল। বিভিন্ন শ্রেনীতে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল আরবের লোকেরা সেই সময়। শ্রেনীতে শ্রেনীতে গোত্রে গোত্রে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বা কোলাহল লেগেই থাকতো। সমাজে পুরষদের সাথে নারীদের কোন সেতু বা বন্ধন ছিল না। নারীদের কোন মূল্যায়ন ছিল না। নারীরা ছিল অবহেলিত এবং ঘৃনিত। ব্যভিচর, মদ্যপান, জুয়াখেলা, নরহত্যা, ধর্ষন, দস্যুবৃত্তি প্রভৃতি অমানবিক আচার অনুষ্ঠানই আরব সমাজে বিরাজমান ছিল। একেশ্বর বাদের আদি উপাসনার ঘর কাবায় ছিল তিনশত ষাটটি দেব দেবীর মুর্তি। প্রত্যেক গোত্রেরই এক বা একাধিক মুর্তি নির্দিষ্ট ছিল। এমনকি বিভিন্ন গোত্রের মানুষ তখন চন্দ্র নক্ষত্র বা সূর্যের ও পূজা করতো। পরকাল আছে বলে কোন গোত্রই মনে করতো না। ঠিক এমন একটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে জন্ম গ্রহণ করেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। পাঁচশত সত্তর খ্রীষ্টাব্দের বারোই রবিউল আউয়াল সোমবার মক্কা নগরীতে তদানীন্তন কালের বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন সভ্যতার পথ প্রদর্শক সকল শ্রেনীর মানুষের কাছে অতি প্রিয় এবং মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। তার পূর্ব পুরুষ হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তার পিতার নাম আবদুল্লাহ, মাতার নাম আমেনা, এবং দাদার নাম আবদুল মুত্তালিব। মহানবীর জন্মের ছয়মাস পূর্বেই তার পিতা আবদুল্লাহ মারা যান, জন্মের কিছুকাল পরই ¯েœহময়ী, মমতাময়ী মা ও ইন্তেকাল করেন। সুতরাং অতি বাল্যকাল থেকেই তাকে সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে দরিদ্রতার ভিতর দিয়ে অতি কষ্টে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছিল। পরিশেষে এতিম বালক হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে হালিমা নামে এক ধাত্রী পুত্র ¯েœহে লালন পালন করেন। পিতা মাতার ইন্তেকালের পর তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিব এবং তার মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিবের কাছে থেকে বড় হতে থাকেন। তিনি অতি ছোট বেলা থেকেই খুবই প্রতিভাবান ছিলেন এবং অত্যন্ত পরিশ্রমী ও ছিলেন। সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শের জন্য এ সময় থেকেই তার সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তার সততার জন্য আরবের লোকেরা তাকে ‘আল আমিন’ বা ‘বিশ্বাসী’ উপধিতে ভূষিত করেছিলেন। অতি বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন চিন্তাশীল, ভাবুক একজন ব্যক্তি, বিয়ের পর থেকেই তিনি ধর্ম চিন্তায় এবং ধর্ম দর্শনে অধিক মনোযোগ দিতে লাগলেন। সৃষ্টি এবং স্রষ্টা সম্পর্কে ব্যপক চিন্তা ভাবনা করতে থাকেন। চারদিকে ব্যভিচার, বিশৃংখলা, সংঘর্ষ, পাপাচার এবং নাস্তিকতা দুর করাই তার চিন্তা ভাবনার মূল বিষয় হয়ে দাড়ায়। মক্কার অদুরবর্তী হিরা পর্বতের নির্জন গুহায় তিনি দীর্ঘ পনের বছর আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকেন। ৬১১ খ্রীষ্টাব্দে চল্লিশ বছর বয়সে তিনি ধ্যান মগ্ন অবস্থায় স্বর্গীয় দূত জিব্রাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে চরম সত্যের সন্ধান পান এবং নবুয়ত লাভ করেন। এমনিভাবে ঐশী বানীর মাধ্যমে তাঁর উপর পবিত্র কোরআন শরীফ নাযিল হয়। শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আরবের মাটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। তার নানা মুখী প্রতিভায়, গুনে ও আদর্শে এবং সত্যবাদিতায় মুগ্ধ হয়ে ধনবতী মহিলা বিবি খাদিজা তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি রাজী হন এবং বিবি খাদিজা কে তিনি বিয়ে করেন। উল্লেখ্য যে, বিয়ের সময় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর বয়স ছিল পচিশ বছর এবং বিবি খাদিজার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। এ সময় থেকেই তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং পরোপকার ও সমাজ সংস্কারে মনোযোগ দেন। শুধুমাত্র আল্লাহর বানী প্রচারের জন্যই নূরনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) প্রেরিত হয়েছিলেন। নবুওত প্রাপ্তির পর তিনি একাজ শুরু করেন। তিনি আরব বিশ্বে প্রচার শুরু করলেন- লা শারিক আল্লাহ আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়, তার কোন শরীক নেই। তিনিই একমাত্র ভরসা তিনিই হচ্ছেন সারা জাহানের, দুনিয়ার ¯্রষ্টা। আমরা সবাই শুধু তাকেই ইবাদত বন্দিগী করবো এবং তার কাছে মাথা নোয়াবো, অন্য কারোর কাছে নয়। তার প্রচারিত ধর্মের নাম হলো ইসলাম ধর্ম বা শান্তির ধর্ম। “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুল্লুল্লাহ” এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ তার প্রেরিত রাসূল। এই মহা সত্য বানী তিনি প্রচার করতে থাকেন। এ সত্য বানী প্রচারের জন্য তাকে অনেক কষ্ট, নিপীড়ন, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। এমনকি মক্কা নগরীর একদল বিপথগামী লোক তাকে হত্যা করার জন্য নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। কিন্তু মহানবী ছিলেন অকুতোভয়, নির্ভীক সাহসী যোদ্ধা। কোন ভয়কে বা ষড়যন্ত্রকে তিনি আমলে নিতেন না। তার একটাই উদ্দেশ্য আরব বিশ্বে শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রচার করা, যত বাধা আসে আসুক সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করে আল্লাহর প্রেরিত কোরআন এবং তার বানী আমি প্রচার করবোই এবং বিপথগামী দের অবশ্যই উৎখাত করবো। এমনকি তিনি এও বললেন- কুরাইশগন যদি আমার ডান হাতে সূর্য আর বাম হাতে চন্দ্র আনিয়া দেয় তবুও আমি সত্য প্রচারে বিরত হইবো না। হয় সত্যের প্রতিষ্ঠা করিব নতুবা প্রাণ দিব। সত্য ইসলাম ধর্ম প্রচারে এই ছিল নূর নবী আমাদের প্রিয় মহানবী (সঃ) এর দৃঢ় প্রত্যয় বা সংকল্প। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ইসলাম ধর্ম প্রচারের ফলে এবং মুর্তি পুজার বিরোধীতা করার কারনে মক্কার কুরাইশগণ তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এবং তাকে হত্যার জন্য বিভিন্ন কৌশল করতে লাগলো। মক্কায় এ মুহুর্তে থাকা নিরাপদ মনে করলেন না তাই স্বয়ং আল্লাহর নির্দেশে হযরত আবু বকর (রাঃ) কে সংগে নিয়ে মদিনায় প্রস্থান করলেন। মহানবী (সঃ) এর এই মক্কা ছেড়ে মদিনায় যাওয়াই হিযরত নামে পরিচিত। বিশ্বাষী ও ধর্ম প্রান মুসলমানদের সংগে নিয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করলেন। মুসলমানদের প্রার্থনার জন্য মদিনায় কাঁচা ইটের গাথুনি এবং খেজুর গাছের পাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি হল মসজিদ। এই মসজিদে বসেই তিনি প্রথমে মসলিম রাজ্যের শাসন কাজ শুরু করেন। ৬২৮ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) মক্কায় হজ্ব করতে গেলে কুরাইশদের সাথে হোদায়বিয়া নামক স্থানে সন্ধি হয় কিন্তু তারা সন্ধির শর্ত ভংগ করলে ৬৩০ খ্রীষ্টাব্দে মহানবী (সঃ) দশহাজার মুজাহিদ সহ মক্কা জয়ের জন্য অগ্রসর হলেন। মক্কার বীর যোদ্ধাগন একে একে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করায় কুরাইশরা বল বা শক্তি হারাতে লাগলো এবং দূর্বল হয়ে পড়েছিল। মুহাম্মদ কে বাধা দেবার মত কোন শক্তিই তাদের ছিল না। মহানবী তার অপূর্ব ধৈর্য, জ্ঞান, দুরদর্শিতা, বিচক্ষনতা ও বিশ্বাসের ফলে কোন সংঘর্ষ বা রক্তপাত ছাড়াই মক্কা জয় করেন। তখন মক্কার লোকেরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করলেন এবং ইসলামের ছায়া তলে আশ্রয় গ্রহন করল। ফলে সমগ্র আরব বিশ্ব ইসলামের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হল। সুুতরাং আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারি মরুভুমি আরবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যে সাহস, যে ধৈর্য, যে নির্ভয় এবং যে বিচক্ষনতা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন পৃথিবীর কোন মানুষের পক্ষে তাহা সম্ভব নহে। তাই তার সততা, তার আদর্শ, তার নীতি, তার নির্ভয়তা এবং বিচক্ষনাতার কাছে কুরাইশ বংশ পরাজয় বরণ করেন। বিশ্বস্ততা, ন্যায় পরায়নাতা, সহিষ্ণুতা, ধৈর্যশীলতা সত্যবাদিতা প্রভৃতি মহৎ গুনাবলী তার চরিত্রকে মাধুর্যমন্ডিত করেছে। সত্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠ্ াতার জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তুলেছে। তিনি ছিলেন ¯েœহময় পিতা, প্রেমময় স্বামী, অসীম দয়ার সাগর, সদাশয় প্রভু এবং নির্ভীক যোদ্ধা। প্রাণঘাতী শত্রæকেও হাতে পেয়ে ক্ষমা করেছেন। এমন মহানুভব ব্যক্তি পৃথিবীতে বিরল। কখনও আর কেহ তার মত হবেনা বা আসবে না। মহানবী কখনও নিজেকে নিয়ে বড়াই করতেন না গর্ব করতেন না তিনি সব সময় বলতেন, “আমি তোমাদের মত মানুষ, আল্লাহর দূত এবং দাস।” তাই আমরা যদি আজ এই সর্বকারের শ্রেষ্ঠ মহামানব আল্লাহর দুতের উপদেশ ও বিচক্ষনতা কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারতাম তবে সমাজে আর কোন হানাহানি মারা মারি থাকতো না। সবাই আমরা এক সংগে সুন্দর পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করতে পারতাম।
লেখক: জহিরুল ইসলাম শাহিন
সহকারী অধ্যাপক
বঙ্গবন্ধু মহিলা কলেজ
কলারোয়া, সাতক্ষীরা।