বুধবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ০৩:০৬ পূর্বাহ্ন

মাদক বিরোধী আন্দোলনে যুব সমাজকে সচেতন হতে হবে

জহিরুল ইসলাম শাহীন / ২১৫
প্রকাশের সময় : শনিবার, ৮ জুলাই, ২০২৩

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মাদকের অরন্য ভূমি রয়েছে, এটা কোন নতুন বিষয় না সুতরাং বাংলাদেশেও যে, মাদকাসক্তি বিরাজমান এটাও কোন নতুন বিষয় না। ভারত, চীন, জাপান, কোরিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক দেশে মাদকের প্রবনতা থাকলেও কোন সমস্যা হয় না কারন ঐ দেশগুলো অনেক বড় স্বয়ং সম্পূর্ন, কোন কিছুতেই ঘাটতি নেই। আবার জনসংখ্যা অনেক কম, শিক্ষা-দিক্ষা ও সভ্যতার হার অনেক বেশী অপর দিকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র দেশ, অধিক ঘন বসতির দেশ। এই সমস্যা টা নিয়ে খুব চিহ্নিত, উদ্বিগ্ন এবং আতঙ্কিত। অতীতে নানা বিধ ভাবে এই সমস্যাটা উত্তোরনের বা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু সম্ভব হয়নি বরং দিন দিন বাড়ছে এর ভয়াবহতা। যুব সমাজ দিন দিন ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে পৌছে গেছে এতে অনেক পরিবার বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এ ভয়াবহ দুরারোগ্য ব্যাধি সমাজে বিষ বাষ্পের মত ছড়িয়ে পড়ছে এবং তরুন সমাজ কে গ্রাস করছে এর নীল দংশনের কারনে একটি সম্ভাবনাময় জাতি কিভাবে পিছিয়ে পড়ে, বাংলাদেশ তার অন্যতম দৃষ্টান্ত। কারন আমরা সকলেই জানি তরুন প্রজন্মই দেশের প্রধান মেরুদন্ড। মাদকাসক্তির ভয়াল ছোবলে পড়ে সেই মেরুদন্ড আজ ভেঙে পড়েছে, এর থেকে এ দেশকে মুক্ত করতে হবে। আমাদের সচেতন হতে হবে এবং প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে। মাদক নাম আমরা শুনেছি আসলে এটা কি, জানা দরকার। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা এর মতে মাদকসক্তি হচ্ছে ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর এমন এক সাময়িক ও নিয়মিত নেশা যা উপর্যুক্তপরি মাদক দ্রব্য অশোধিত বা শোধিত গ্রহনের ফলে সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ মাদক দ্রব্য আইন ১৯৮৯ মোতাবেক মাদকাসক্ত বলতে দৈহিক বা মানসিকভাবে মাদক দ্রব্যের উপর নির্ভরশীল ব্যবহারকারী ব্যক্তি বোঝায়। যে ব্যক্তি দৈহিক বা মানসিক ভাবে মাদক দ্রব্যের উপর নির্ভরশীল হয় বা মাদক দ্রব্য ব্যবহারে অভ্যস্ত করে তাকে আমরা মাদকাসক্ত বলি। সাধারনত বেদনা বোধ কমানো বা বন্ধ করার জন্য ব্যক্তি যে ভেষজ দ্রব্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং প্রযোগ করে তাকে মাদকাসক্তি বলে। আজকের বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা মাদকাসক্তির দৈহিক ও মানসিক প্রতি-ক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে মাদকাসক্তিকে বিভিন্ন শ্রেনীতে ভাগ করেছে। অবসাদ সৃষ্টিকারী মাদক মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় উত্তেজনা সৃষ্টিকারী মাদক মানুষের মস্তিষ্কে ও ¯œায়ুতন্ত্রে উত্তেজনা সৃষ্টি করে থাকে। আবেশ ও নিদ্রা উদ্রেককারী মাদক দুশ্চিন্তা ও হতাশাগ্রস্ত মানুষের মাঝে এক ধরনের শক্তি আবেশ ও নিদ্রার উদ্রেক করে, এ ছাড়া যন্ত্রনা লাঘব-কারী মাদক মানুষের অনুভূতিকে অবশ করে দেয়, ফলে ব্যক্তি কোন ধরনের যন্ত্রনা উপলব্ধী করতে পারে না। মাদক এখন শুধু শহরে বিস্তার লাভ করছে না, গ্রামে গঞ্জেও এর ভয়াবহতা এবং প্রভাব ছড়িয়ে আছে। শহরে তো সর্বত্রই মাদক ছড়া-ছড়ি, গ্রাম, গঞ্জে এখন, মোড়ে মোড়ে দোকান পাঠ মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা থাকে এবং গ্রামের তরুন সমাজ ঐখানে বসে আড্ডা দেয়, জোয়া খেলে ক্যারম বোর্ড খেলে এবং আস্তে আস্তে মাদক গ্রহন করতে থাকে। মাদকের ধ্বংতœক প্রভাব সমাজ জীবনকে কুরে কুরে খাচ্ছে তবে যে সকল ক্ষেত্রে মাদকাসক্তির প্রভাব বিদ্যমান যে ক্ষেত্র গুলোকে উন্মোচন করতে হয়তো বা এর প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। আর তা না করা গেলে মাদকাসক্তি ব্যক্তি ধীরে ধীরে কর্ম ক্ষমতা ও উপার্জন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তাই তার মধ্যে দারিদ্র ও নির্ভরশীলতা সৃষ্টি করে এবং পরিশেষে রাসায়নিক ক্রিয়ার নেশায় অকাল মৃত্যুর দিকে পা বাড়ায় নেশাগ্রস্থ ব্যক্তির মানসিক ও শারিরীরক কর্যক্রম স্থিমিত হয়ে পড়ে, ফলে নেশা অবস্থায় কোন কাজ করলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। নেশা গ্রহনের ফলে ব্যক্তির মধ্যে অস্থিরতা, অপ্রকৃতিস্থতা. অসাভাবিকতা. বিচার বুদ্ধিহীনতা এবং পাশবিকতা পরিলক্ষিত হয়। ফলে নেশা গ্রস্থ ব্যক্তির দ্বারা পরিবারে, সমাজে বা দেশে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রবনতা বেড়ে যায়। মাদক দ্রব্য গ্রহনের ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, বাবা-সন্তানের মধ্যে, সন্তান-সন্তানাদির মধ্যে বা ভাই বোনের মধ্যে এবং বিশেষ করে পারিবারিক জীবনে চরম অনিশ্চয়তা ও অশান্তি বিরাজ করে। বিশেষ করে একটা পরিবারের শিশুদের জীবন বিপন্ন হয় ঐ মাদকাসক্তি ব্যক্তির দ্বারা যুব সমাজ যে, ভবিষ্যতের কর্নধার বা নেতৃত্ব দেবে অতিরিক্ত মাদক গ্রহনের ফলে তারা নেতৃত্ব হারায় এবং সমাজে ঘৃনীত ব্যক্তিতে পরিনত হয়। মাদকের ফলে শ^াসকষ্ট জনিত রোগ, ব্রেন টিউমার, কিডনি ড্যামেজ, লান্স নষ্ট এবং হার্ট এ্যাটাক ও ক্যানসার এর মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন সমস্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাদকাসক্তি। তবে আধুনিক নেশা হেরোইন এর আর্বিভাব ২৫-৩০ বছর আগে থেকে, বর্তমানে নতুন নেশা হিসাবে আর্বিভূত হয়েছে ইয়াবা, আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগেও মাদক দ্রব্যের সেবন ছিল খুবই সীমিত তখন বাংলাদেশের রাস্তাঘাট অতটা ভাল ছিলনা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ততটা উন্নত ছিলনা, প্রযুক্তি নির্ভর তখন ততটা বাড়েনি বেশীর ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করতো ফলে মাদকের ব্যবহার কিছুটা নিয়ন্ত্রের মধ্যে ছিল। জাতি যত উন্নত হচ্ছে যত প্রযুক্তি নির্ভর হচ্ছে, যত শিক্ষিত হচ্ছে, মাদক সেবনও ততটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত এক যুগধরে এর সেবন এমন আকার ধারন করেছে যে, গোটা দেশ আজ এর ভয়াবহায় আতঙ্কিত। এমনকি এর প্রবনতা মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলোতে ও ছড়িয়ে পড়েছে। নিয়ন্ত্রন করা কিছুটা কঠিন হয়ে পড়েছে। মাদক সেবনের প্রবনতা বেশী হবার কারনে বর্তমান সমাজে যুবক যুবতীদের মধ্যে আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করা নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, মাদক দ্রব্যের সহজলভ্যতা, বাজে সঙ্গীদের সাথে সঙ্গ দেওয়,া ¯œাযু ও মস্তিষ্কের চাপ লাঘব, কালো টাকার উত্তাপ, পিতা মাতার সহচার্য ও আদর ¯েœহের অভাব পিতা মাতার মধ্যে অসচেতনতা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে অস্থিরতা, রাজনৈতিক ও সমাজিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীন ক্ষমতা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি, বেকারত্ব, কৌতুহল নিবারন ও প্রবল আগ্রহ পূরন সাংস্কৃতিক বিপর্যয় আইন শৃঙ্খলার অবনতি সঠিক ভাবে প্রয়োগ না করা। মাদকের কুফল ও ভয়াবহতা প্রসঙ্গে অঙ্গতা ও অসচেতনতা এই সব কিছু রাতারতি বা হঠাৎ করে বা একদিনে বেড়ে ওঠেনি দিন দিন এর প্রতি আসক্তি জন্মায়। সেই সংগে অতি দ্রæত শহর ও গ্রামে উভয় এলাকাতেই মাদকাসক্তি মারাত্মক ভাবে বিস্তার লাভ করছে। আজকের এবং আগামির ভবিষ্যৎ ও কর্নধার তরুন সমাজকে মাদকাক্তির মতো সর্বনাশা ছোবল থেকে তরুন সমাজ ও দেশকে রক্ষা করতে হলে অতান্ত সতর্কতার সাথে সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহন অপরিহার্য। আর কাল বিলম্ব না করে এখনই সময় এসেছে প্রতিকার ও প্রতিরোধ মূলক পদক্ষেপ নেওয়ার মাদক নেশায় আসক্তদের শারিরীক মানসিক ও সামাজিক ভাবে সুস্থ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা এখনই সময়ের দাবি। তাদেরকে চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের শারিরীক ও মানসিক যে অশান্তি ও অস্থিরতা দুর করতে হবে। মাদকাসক্তির হাত থেকে সমাজ ও সমাজের মানুষকে রক্ষা করার জন্য প্রতিরোধ মূলক পদক্ষেপ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ও কার্যকারী কেননা একমাত্র এ পদক্ষেপের মাধ্যমেই সমাজ থেকে নেশার বিস্তার রোধ করা সম্ভব। আইনের মাধ্যমে মাদক দ্রব্যের উৎপাদন ও আমদানি নিষিদ্ধ করা উচিত। আইন প্রয়োগ করে মাদকাসক্তদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে অন্যরা ভয় পেয়ে যায় মাদকের ধারে কাছেও যেন ঘেষতে না পারে। অবৈধ ব্যবসা ও সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। তাদের মধ্যে মানসিক মূল্যবোধ গঠন ও পরিবেশনের ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। তরুন সমাজকে মাদকের কুফল নিয়ে সেমিনার বা সভার মাধ্যমে পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রতি তাদের কে আগ্রহী করে গড়ে তুলতে হবে। অপসংস্কৃতির বিস্তার রোধ করতে হবে। রেডিও, টিভি, বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেল, ফেসবুক, ইউটিউব, সিনেমা, ম্যাগাজিন এর মাধ্যমে জনগনকে সচেতন করতে হবে। প্রত্যেকটা শ্রেনীতে মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে ছোট গল্প, রচনা, কবিতা, ইত্যাদি অন্তর্ভূক্ত করতে হবে যাতে সকল শিক্ষার্থী ও বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। সুষ্ঠ ও গঠন মূলক চিত্ত বিনোদন এর ব্যবস্থা করতে হবে। সম্মিলিত ভাবে সরকার ও বিরোধী দল সহ বিভিন্ন সংস্থাভিত্তিক সংগঠন এবং সকল শ্রেনীর জনগন কে সোচ্চার বা সচেতন করতে পারলে এবং সাবই মিলে চেষ্টা করলে অবশ্যই আমরা এটা খুব সহজেই নিয়ন্ত্রন করতে পারবো। মাদকের ভয়াবহতা ও বিপদ সম্পর্কে আবারো পত্রিকার মাধ্যমে জনগনকে একটু সচেতন করাই আমার উদ্দেশ্য। কারন এ মুহূর্তে দেশ রসাতলে, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌছে গেছে, এক্ষনে যদি রোধ করা না যায় তাহলে বিপদের শেষ নেই। তাই আসুন সবাই মিলে বজ্্র কষ্ঠে শ্লোগান তুলি, মাদক প্রতিরোধ করি, মাদককে না বলি এবং আমরা আমাদের দেশকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করি (দেশকে বাচাই)।

লেখক: জহিরুল ইসলাম শাহীন
সহঃ অধ্যাপক
বঙ্গবন্ধু মহিলা কলেজ
কলারোয়া, সাতক্ষীরা।


এই শ্রেণীর আরো সংবাদ